করোনা ভাইরাস ও আমাদের করণীয়
মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ
অধ্যক্ষ
দারুল ইরফান একাডেমি, চট্টগ্রাম।
ডিসেম্বর-২০১৯ এর শেষদিকে চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস নামক রোগটি আজ বিশ্বের প্রায় ১৩০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতোমধ্যে এটিকে বৈশ্বিক মহমারী আখ্যা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এতে বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশ্ব ব্যাপী এক আতংক ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আরামের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এ ভ াইরাস থেকে মুক্তির জন্য অনেকেই একাকীত্ব জীবনে চলে গেছেন। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সকল প্রিন্ট মিড়িয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিড়িয়ার শিরোনাম হচ্ছে “করোনা ভাইরাস”। মুজিব শতবার্ষিকী পালনে ও ভাটা পড়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো।
১। হতাশ ও আতংকিত হওয়া যাবে না:
আমাদের পরিচয় হলো আমরা মুসলমান। যে কোন বিপদ আপদ মুসীবতে মুসলমানরা কখনো হতাশ ও আতংকিত হয় না। কারণ আমরা বিশ্বাস করি সকল প্রকার বিপদ আপদ মুসীবত আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা আমাদের ঈমানের দাবী পুরণে আমরা কতটুকু শক্তিশালী তা পরীক্ষা করার জন্যই দিয়ে থাকেন। যেমন পবিত্র কুরআন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنْ الأَمْوَالِ وَالأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرْ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ- بقرة-১৫৫
অর্থ্যাৎ:আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, ভয়-ভীতি, ক্ষুধা-অনাহার, জানমাল ও ফসলাদির ক্ষতি সাধন করে। তুমি ধৈর্যশীলদের কে সু-সংবাদ দান কর।যখন তাদের ওপর কোন বিপদ আপদ আসে তখন তারা বলে, নি:সন্দেহে আমরা আল্লাহ তায়ালার জন্যে। অবশ্যই আমরা একদিন তাঁর কাছেই ফিরে যাব। (বাকারা- ১৫৫)
অন্যআয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَلا تَهِنُوا وَلا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمْ الأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
অর্থ্যাৎ:তোমরা হতাশ ও চিন্তিত হয়োনা তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও। (আলে ইমরান-১৩৯)
২।চিকিৎসা করাতে হবে:
রাসুল (স:) বলেছেন-لكل داء دواء‘ فاذا اصيب دواء الداء برأ باذن الله- (مسلم) প্রত্যেক রোগেরই ঔষধ আছে। যদি কোন রোগের সঠিক ঔষধ প্রদত্ত হয়, তাহলে আল্লাহর অনুমতিতে রোগমুক্তি হয়। (মুসলিম)
৩। পরিমিত খাওয়ার খেতে হবে:
রাসুল (স:) বলেছেন- ما ملأ ادمى وعاء شرا من بطن حسب الادمى لقحمات يقمن صلبه فان غلبت الادمى نفسه فثلث للطعام وثلث للشراب وثلث للنفس- (ترمذى) অর্থ্যাৎ: আদম সন্তান তার নিজের পেটের চেয়ে নিকৃষ্টতর কোনো পাত্রপূর্ণ করেনি। দেহকে সুস্থ সবল কর্মক্ষম রাখতে যতটুক খাদ্য প্রয়োজন ততটুকু একজন মানুষের জন্য যথেষ্ঠ। যদি কোনো মানুষের খাদ্যস্পৃহা বেশী প্রবল হয় তবে সে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য ও এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে। (তিরমিযি)
৪। সংক্রমক রোগের বিষয়ে রাসুল (স:) এর নির্দেশনা: তিনি বলেন, لا عدوى فقام اعرابى فقال أرايت الإبل تكون فى الرمال أمثال الظباء, فيأ تيها البعير الاجرب فتجرب‘ قال النبى صلى الله عليه وسلم فمن أعدى الاول؟অর্থ্যাৎ:(সাধারণভাবে) সংক্রমনের অস্তিত্ব নেই। তখন এক বেদুইন দাঁড়িয়ে বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আমার উটগুলো হরিণীর ন্যায় সুস্থ থাকে। এরপর একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এগুলোর মধ্যে প্রবেশ করার পরে অন্যান্য উটও আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন রাসুল (স:) বললেন তাহলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমিত করল? (বুখারি, হাদিস নং- ৫৭৭৫)।
৫। রাসুল (স:) এর নির্দেশনা মেনে চলতে হবে:
ক) অসুস্থকে সুস্থ থেকে আলাদা রাখবে, যদি কোনো মহামারী দেখা দেয় সে ব্যাপারে রাসুল (স:) বলেন, لا يورد ممرض على مصح-(بخارى-مسلم) অর্থ্যাৎ: অসুস্থকে সুস্থের মধ্যে নেওয়া হবে না। (বুখারী-মুসলিম)
খ) আক্রান্ত এলাকা এড়িয়ে চলবে: রাসুল (স:) বলেছেন, اذا سمعتم بالطاعون بأرض فلا تدخلوها- (بخارى)অর্থ্যাৎ:যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোন জনপদে মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না।(বুখারী)
গ) আক্রান্ত এলাকা থেকে বের হওয়া যাবে না: রাসুল (স:) বলেছেন, واذا وقع بأرض وانتم بها فلا تخرجوا منها- (بخارى) আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না। (বুখারী, হাদিস নং- ৫৭২৮)।
- রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আরো কিছু শরয়ী নির্দেশনা:
ক) খাদ্য ও পানীয় আবৃত রাখা।
খ) খাদ্য ও পানীয়তে শ্বাস-নিশ্বাস না ফেলা তথা ফুঁ না দেয়া।
গ) কঠিন রোদ্রে চলাফেরা না করা।
ঘ) ময়লাযুক্ত হাত পানিতে প্রবেশ না করিয়ে পানি আলাদা নিয়ে ধৌত করা।
ঙ) কুকুরের ঝুটাযুক্ত পাত্র মাটি/পানি দিয়ে ৭/৮ বার ধৌত করা।
চ) ডান হাতে খাওয়া ও বিসমিল্লাহ বলে ড ান দিক থেকে খাওয়া। খাওয়ার শেষে আল হামদুলিল্লাহ বলা।
ছ) খাওয়ার পূর্বে ভাল ভাবে হাত ধৌত করা।
জ) টয়লেট শেষে সাবান দিে য় হাত ধৌত করা।
ঝ) হাঁছি আসলে মুখে হাত/রুমাল দেয়া। হাছির পর আল হামদুলিল্লাহ বলা।
সর্বোপরী মহান আল্লাহর উপর ভরসা করা ও নি¤েœর দোয়াগুলি নিয়মিত আমল করা।
১। اللهم انى اعوذبك من البرص والجنون والجزام ومن شئ الاسقام. অর্থ্যাৎ: হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ধবল,কুষ্ঠ, পাগল হওয়া ও সকল প্রকার ব্যাধির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (আবু দাউদ)
২। بسم الله الذى لا يضر مع اسمه شئ فى الارض ولا فى السماء وهو السميع العليم.অর্থ্যাৎ: আল্লাহ তায়ালার নামে (আশ্রয় গ্রহণ করছি) যার নাম নিয়ে থাকলে আসমান-যমীনের কোন কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।
৩। اعوذ بكلمات الله التامة من شر ما خلق অর্থ্যাৎ: আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি আল্লাহ তায়ালার সকল পরিপূর্ণ শব্দের, ঐ সকল বস্তুর অনিষ্ট থেকে যা তিনি সৃষ্টি করেছেন।
৪। সকল প্রকার গুনাহ ও অশ্লীল কাজ হতে দূরে থাকা:রাসুল (স:) বলেছেন- لم تظهر الفاحشة فى قوم قط حتى يعلنوا بها إلا فشا فيهم الطاعون والاوجاع التى لم تكن مضت فى أسلافهم الذين مضوا- (ابن ماجه) অর্থ্যাৎ: যখন কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে তাকে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব রোগ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রসারিত ছিল না। (ইবনে মাজাহ)
৫। সৎকাজের আদেশ দেয়া অসৎকাজের নিষেধ করা: রাসুল (স:) বলেছেন: إن الناس اذا راو منكرا فلم يغيروه يوشك ان يعمهم الله بعقابه- (ترمذى) অর্থ্যাৎ: নিশ্চয়ই মানবগণ যখন কোন মন্দকাজ দেখে অত:পর তাকে প্রতিহত না করে তবের্ অচিরেই আল্লাহ পাকে তার শাস্তির মধ্যে সকলকে অন্তর্ভূক্ত করে নেবেন। (তিরমিযি)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সকল বিপদ-আপদ, মুসীবত থেকে হেফাজত করুন। সর্বদা ন্যায়ের পথে চলা ও অন্যায়কে প্রতিহত করার মানসিকতা লালন ও পালন করার তৌফিক দিন। করোনা ভাইরাস থেকে আমাদের দেশ ও সকল মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করুন। আমিন
অধ্যক্ষ
দারুল ইরফান একাডেমি, চট্টগ্রাম।